বাবার এককালীন পেনশনের টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করা কি যৌক্তিক?

বাবার এককালীন পেনশনের টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করা কি যৌক্তিক?

বাবার এককালীন পেনশনের টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করা কি যৌক্তিক

Bangla Preneur ফেসবুক পেইজে একজন পাঠক জানতে চেয়েছিল বাবার এককালীন পেনশনের টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করা যৌক্তিক কিনা তার উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছি।  

জীবনে বড় হতে গেলে আমাদের বিভিন্ন ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। কঠিন কঠিন সব সিদ্ধান্ত নিতে হয়। বলা বাহুল্য সেই সব সিদ্ধান্ত অবশ্যই যৌক্তিকতার বিচারে নিতে হয়, আবেগের বশে না।

সেই কোন শিশুকাল থেকে আমাদের জীবনের সাজিয়ে গুছিয়ে দেওয়ার এক অলিখিত দায়িত্ব নিয়েছেন বাবা নামের মানুষটি। রক্ত জল করা টাকা দিয়ে খাবার, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা এবং শখ পূরণ করতে যে মানুষটি পিছপা হয়নি কখনোই।

প্রতিটি টাকার সাথেই বাবাদের আত্মত্যাগের গল্প জড়িয়ে থাকে। এর প্রতিদানে সে চায় আমাদের সাফল্য, আমাদের সুন্দর জীবন। বৃদ্ধ বয়সে কাজ করতে করতে ক্লান্ত হাতটি চায় একটি সবল হাতের স্পর্শ। চায় পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি।

দুঃখের বিষয় এইটুকু দিতেই আমাদের কার্পূণ্যের শেষ নেই। সন্তানের সুখের জন্য শেষ বয়সের শেষ সম্বল অর্থ্যাৎ, পেনশনের টাকাটা সন্তানের হাতে তুলে দিতে দ্বিধা করেন না তিনি। এই মানুষটিই বাবা। কিন্তু বাবার একখালীন পেনশনের টাকা নিয়ে ব্যবসা করা কি সত্যিই যুক্তি সংগত?

ব্যবসা করে সফল হয়েছেন অনেক মানুষ। ব্যবসা আয়ের একটি খুবই প্রচলিত এবং প্রাচীন উপায়। আমাদের নবীজীও ব্যবসা করতেন। কিন্তু সকলেই ব্যবসা করে সফল হতে পারে না। অচিরেই হারিয়ে যায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।

ব্যবসার ব্যর্থতার কারণ নিয়ে অন্য কখনো আলোচনা করা হবে। তবে টাকা বিনিয়োগ করে ব্যর্থ হতে হলে, এটি রীতিমতো একটি বিশাল ধাক্কা। অনেকেই ঘুরে দাঁড়াতে পারেন, আবার অনেকেই পারেন না।

বাবার এককালীন পেনশনের টাকা নিয়ে যে ছেলে বা মেয়ে ব্যবসা করতে চাইছে, স্বাভাবিক ভাবেই ধরে নেওয়া যায় সে এখনো আর্থিক ভাবে তার পিতার উপর নির্ভরশীল। এমন অবস্থায় এত বড় ঝুঁকি নেওয়া কি সঠিক সিদ্ধান্ত?

বাস্তব অভিজ্ঞতার একটি ঘটনা শেয়ার করি। এক বৃদ্ধ পিতার ২ ছেলে। ২ জনেই বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকুরিজীবী। সঞ্চয় তেমন হয়ে ওঠে না তাদের। ২ জনেই সরকারী চাকুরির প্রত্যাশায় পিতার পেনশনের টাকা ঘুষ দিয়েছে। লাভ হয়নি।

টাকা হারিয়েছে ২ জনই। ছোট ভাইয়ের ইতিমধ্যে চাকুরি চলে যায় এবং মহামারী করোনা ভাইরাসের কারনে বড় ভাইয়ের বেতনের ২০% কমিয়ে দেয় প্রতিষ্ঠান থেকে।

ব্যবসার জন্য ছোট ভাই আবারও বাবার পেনশনের টাকা থেকে বিনিয়োগ করে এবং এবার সফল হতে পারে নি। ইতিমধ্যে  বাবা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন।

পরিপূর্ণ চিকিৎসার আগেই তাকে ফিরিয়ে আনতে হয় হাসপাতাল থেকে। কারণ হাসপাতালের খরচ করার মত যথেষ্ট টাকা আর বাবার একাউন্টে নাই। বর্তমানে পুরো পরিবার চলছে অভাবের টানাপোড়ানে।

বৃদ্ধ পিতার চিকিৎসা এখন বাড়তি খরচ। বলুন তো , কি পেলেন মানুষটি? ২ জন ছেলেকেই তিনি উচ্চ শিক্ষিত করেছেন, উপযুক্ত করেছেন।

তাদের সুখের জন্য নিজের শেষ সম্বলটুকুও ক্রমান্বয়ে টাকা খরচ করে গেছেন। কিন্তু পারেন নি। জীবন যুদ্ধে হেরে যাওয়া মানূষটি এখন বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর জন্য দিন গুনছেন।

আমরা জানি আপনি এমন কিছু চান না। আপনি আপনার পরিবারের প্রতি অধিক মনযোগী এবং সহানুভ’তিশীল। বাবার এককালীন পেনশনের টাকা দিয়ে ব্যবসা না আসাই উত্তম । কারন:

১। বেশি ঝুঁকি

ব্যবসায় লাভ লোকসান সবই আছে। আপনি প্রথমেই সফল হবেন বিষয়টি এমন নয়। ব্যর্থতাও আসতে পারে। বাবার এককালীন পেনশনের টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করার অর্থ হচ্ছে একটি বড় ঝুঁকি নেওয়া, যেখানে বিজয় অনেকটাই অনিশ্চিত।

২। পরিবারকে বিপদে ফেলা

আপনার বাবা যদি হয়ে থাকে আপনার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি এবং তার টাকার ওপর যদি আপনার পুরো পরিবার নির্ভর করে থাকে, তবে ভ’ল করেও এই কাজ টি করবেন না।

আপনার একটি ভুল সিদ্ধান্তের কারণে পুরো পরিবার বিপদগ্রস্থ হবে। আপনি ব্যর্থ হলে আপনার পরিবারে হয়তো খাবার টাকাও থাকবে না। আর নিজের ভুলের জন্য পরিবারের মানুষের এই কষ্ট আপনাকে ভিতরে ভিতরে তিল তিল করে শেষ করে দিবে।

আপনার কারনে যদি আপনার পরিবারের প্রাথমিক চাহিদা গুলো পূরন না হয়, এই ব্যর্থতা আপনার ঘুড়ে দাঁড়ানোর সাহস টাও কেড়ে নিবে।

৩। অন্য ভাইবোনের ভবিষ্যৎকে নষ্ট করবে

আপনার পরিবারে আপনি ছাড়াও আরো অনেক মানুষ আছে। আপনার ভাইবোন আছে। এবং তারাও আপনার বাবার ওপর নির্ভরশীল।

এমন অবস্থায় বাবার এককালীন পেনশনের টাকা নিয়ে আপনি ব্যবসা শুরু করে যদি ব্যর্থ হন, তবে তার প্রভাব আপনার ভাইবোনের জীবনও ধ্বংস করে দিবে।

তাদের শিক্ষাসহ সকল খাতেই বিড়ম্বনা সৃষ্টি হবে। এবং এর জন্য অদূর ভবিষ্যৎতে তারা আপনাকেই দায়ী করবে। এই দায়ভার অস্বীকার করার কোন উপায় নেই আপনার।

৪। বাবা-মার চিকিৎসা ব্যাহত হবে

আপনার হাতে যদি আপানর বাবা পেনশনের সকল টাকা তুলে দেন, তবে দিনশেষে তার হাতে কি থাকবে? বয়সের সাথে সাথে রোগ বালাই বাড়বে। সাধারণ একটু জ্বর হলে যেখানে ডাক্তারগণ কমপক্ষে ৩/৪ টি টেস্ট করতে দেন, সেখানে বৃদ্ধ বয়সের নানা জটিল রোগের খরচ কতটা হবে ভেবে দেখুন।

ঔষধের দাম এখন আর নাগালের মধ্যে নেই। এমন অবস্থায় যদি ওপেন হার্ট সার্জারি, হাটে রিং বসানো কিংবা কিডনী সংক্রান্ত জটিল রোগ হয় তবে পরিস্থিতি কত ভয়াবহ হয়ে পড়বে চিন্তা করুন।

বৃদ্ধ বয়সে বাবার পাশে দাঁড়াতে পারছেন না এ কথা মেনে নিতে পারলেও, আপনার কারণে আপনর বাবা মার চিকিৎসা হচ্ছে না একথা মেনে নেওয়া খুবই কষ্টের। সুতরাং বাবার এককালীন পেনশনের টাকা নিয়ে ব্যবসা করার আগে বার বার ভাবুন।

৫। আকর্ষিক বিপদ

বিপদ কখনো বলে কয়ে আসে না। বিপদ যখন তখন আসতে পারে। সুতরাং তার জন্যও আমাদের ভাবতে হয়। বিপদের দিনে হাত পেতে টাকা চাইলেও টাকা পাওয়ার নিশ্চয়তা নেই। এমন হতে পারে যার কাছে আপনি চাইছেন, তিনি ইচ্ছে থাকলেও দিতে পারছেন না। কারন তার কাছে পর্যাপ্ত টাকা নেই।

আবার টাকা ধার দেওয়ার আগে মানুষ চিন্তা করে আসলেই কি টাকা সে ফেরত দিতে পারবে। এই চিন্তা অযৌক্তিক নয়।

কারন টাকাটা নিশ্চয় তারও কখনো প্রয়োজন হবে। আপনি যখন ব্যবসায় ভাল করতে পারছেন না, আপনার পরিবারের একমাত্র উর্পাজনক্ষম ব্যক্তিও বৃদ্ধ, তখন টাকা ধার পাওয়া তুলনামূলক কষ্টকর।

সুতরাং বিপদের দিনে কিভাবে মোকাবেলা করবেন সেই বিষয়েও ভাবুন।

ব্যবসা করে সফল হতে অনেকেই চায়, সফলও হয়। আমরা আপনাকে হতাশ করছি না। শুধুমাত্র ঝুঁকির বিষয়টি তুলে ধরছি।

সফলতার অপর পিঠেই থাকে ব্যর্থতা। সফল হওয়ার আগে সবাইকেই ব্যর্থতার স্বাদ গ্রহন করতে হয়। এটাই নিয়ম।

এখন কতটুকু ব্যর্থতা আপনি গ্রহণ করতে সক্ষম, সেই বিষয়ে ভাবুন। বাবার এককালীন পেনশনের টাকা নিয়ে ব্যবসা শুরু করার এই সিদ্ধান্তের সাথে আপনার পুরো পরিবারের ভবিষ্যৎ জড়িয়ে আছে।

সুতরাং, সিদ্ধান্ত নিতে হবে বিচার বিবেচনা করে। বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে অনেকেই ব্যবসা করেন এবং সফলও হন। কিন্তু সেই টাকাটাই যেন বৃদ্ধ বাবা মায়ের একমাত্র অবলম্বন না হয়, সেটি খেয়াল করবেন।

আপনার বাবার সঞ্চয়কৃত টাকা থাকলে সেখান থেকে কিছু পরিমান টাকা নিয়ে আপনি ব্যবসা শুরু করতে পারেন। তবে কখনোই সম্পূর্ণ টাকা দিয়ে নয়। ব্যবসায় ভাল করলে ক্রমান্বয়ে টাকা আবার বিনিয়োগ করতে পারেন তবে চেষ্টা করুন লাভের অংশ থেকে পুনুরায় বিনিয়োগ করতে।

কারণ যতক্ষন সঞ্চিত টাকা থাকবে, আপনি বিপদে পড়লে পুনুরায় চেষ্টা করতে পারবেন। আবার একবারেই সবটাকা বিনিয়োগ করে ব্যর্থ হলে, পুনুরায় বিনিয়োগের জন্য আর কিছুই থাকবে না।

আর তাই বাবার এককালীন পেনশনের টাকা দিয়ে যদি বিনিয়োগ করতেই হয়, তবে সেক্ষেত্রে সব টাকা বিনিয়োগ করবেন না। মনে রাখবেন আপনার সিদ্ধান্তের সাথে আপনার পরিবারও বিশেষ ভাবে জড়িত। ভিজিট করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল – Bangla Preneur YouTube Channel