শেয়ার বাজারে সফল হওয়ার কিছু দিকনির্দেশনা

Stock Market Strategies for Beginners | শেয়ার বাজারে সফল হওয়ার কিছু দিকনির্দেশনা

শেয়ার বাজারে সফল হওয়ার কিছু দিকনির্দেশনা

শেয়ার বাজারে সফল হওয়ার কিছু দিকনির্দেশনা

শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ একটি দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা। এটি কোন T20 ক্রিকেট ম্যাচ না যে, আসলাম দেখলাম আর ছক্কা মরলাম। যারা এখানে বিনিয়োগ করে তারা একটা পর্যায়ে সবাই কম বেশি লাভ করতে পারে।

তবে এই লাভ ঠিকিয়ে রাখা, কিংবা লাভ চলমান রাখা চারটি খানি কথা না। ১ লাখ টাকা বিনিয়োগ করলাম, কিছু দিন পর ১০ হাজার টাকা লাভ হলো, আবার বিনিয়োগ করলাম এবার লস হলো, আবার বিনিয়োগ করলাম কিছু লাভ হলো, এভাবে যদি চলে তাহলে বাস্তবিক অর্থে লাভ আর হয় না।

আপনি যতক্ষন পর্যন্ত লাভের টাকা ঘরে তুলতে পারবেন না ততক্ষন কোন লাভই লাভ হিসাবে গন্য হবে না। শেয়ার বাজার অনেক সহজ বার অনেক জটিল। এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, এখানে অধিকাংশ মানুষ টাকা লস করে।

আর কিছু মানুষ লাভ করতে পারে। একজন বিনিয়োগকারী হিসাবে আমরা অনেকেই লাভ নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করি। আমরা যেই শেয়ারটা কিনি তার দাম কত বাড়তে পারে এই চিন্তা করি, খুব কম মানুষ আছে যারা কত টাকা কমতে পারে এই চিন্তা করে।

যারা একটা শেয়ার কেনার পর, কত টাকা কমতে পারে এই চিন্তা করতে পারে তারাই মার্কেট থেকে লাভ করতে পারে। শেয়ার বাজারে আপনার টাকা বিনিয়োগ করার পর, দুইটি জিনিষ ঘটবে।

এক হয় লাভ হবে, না হয় লস হবে। তবে মনে রাখতে হবে শেয়ার বিক্রি করা না পর্যন্ত কোনো লাভই লাভ না এবং কোনো লসই লস না। আমরা যদি আমাদের বিনিয়োগকৃত টাকার মধ্যে লস কমাতে পারি কিংবা, এড়াতে পারি তাহলে আমাদের লাভ সুনিশ্চিত, ইনশা আল্লাহ।

আসুন শেয়ার বাজারে সফলতার কিছু কার্যকারী উপায় জানার চেষ্টা করি। এটি মূলত নতুনদের জন্য কাজে দিবে, তবে আমরা যারা পুরাতন আছি, ইনশা আল্লাহ তারাও কিছু চিন্তার খোরাক পেতে পারি।

#১। পরিকল্পনা করা।

এই বিশ্বে সকল সফলতার পিছনে রয়েছে একটা কার্যকর পরিকল্পনা। পরিকল্পনা না করা মানে হচ্ছে, নদীর গভীরতা না মেপে ঝাঁপ দেওয়া। শেয়ার বাজারে পরিকল্পনা ছাড়া দুই/এক বার লাভ আসতে পারে, তবে এই লাভ টিকে থাকার সম্ভাবনা খুবই সামান্য।

তাই আপনি যখন বিনিয়োগে আসবেন এর আগে আপনার একটা সঠিক প্লান থাকা চাই।

যেমন, কত টাকা বিনিয়োগ করবেন, কত দিনের জন্য করবেন, বছরে সম্ভাব্য কত পারসেন্ট লাভের আশা করছেন, যেই টাকা বিনিয়োগ করবেন এর উৎস কি ইত্যাদি নানা বিষয় মাথায় রেখে পরিকল্পনা করে আসতে হবে।

অনেকে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগকে মূল পেশা হিসাবে নিতে পারে, যদি মূল পেশা হিসাবে কেউ নেয় তাহলে তার পরিকল্পনা আরো বেশি পরিস্কার থাকতে হবে।

#২। সব সময় শেখার আগ্রহ ধরে রাখা

আমাদের মধ্যে অনেকেই আছে যারা শেয়ার বাজারে ১০/১২ বছর ধরে আছে, কিন্তু এখনো তার জ্ঞানের পরিধি বাড়াতে পারে নাই। শেয়ার বাজারে কখনোই কেউ একদম শতভাগ বিজ্ঞ হতে পারে না, তবে যদি তার মধ্যে জানার ও শেখার আগ্রহ থাকে তাহলে সে অন্য বিনিয়োগকারীদের থেকে অনেক এগিয়ে থাকবে।

কেননা, সব সময় নতুন কিছু জানার আগ্রহ মানুষকে সাফল্য পেতে সাহায্য করে।

#৩। কারন ছাড়া শেয়ার না কেনা

আপনি যখন একটা শেয়ার কিনবেন তখন এর পিছনে যদি কোনো কারন না দেখাতে পারেন তবে সেই শেয়ার থেকে লাভ করাটা কঠিন হয়ে যাবে।

একটা শেয়ারের দড় যখন ক্রমাগত বাড়তেই থাকে তখন আমরা, অর্থাৎ সাধারন বিনিয়োগকারীরা সেই শেয়ার কেনার জন্য ঝাঁপিয়ে পরি।

ফলে, অতিমুল্যে শেয়ার কিনে লসের ভাগিধার হয়ে যাই।  যখন একটা শেয়ার কিনবো এর পিছনে যথেষ্ট কারন নির্ণয় করেই কিনতে হবে।

কারন খুঁজে বের না করে শেয়ার কেনা মানে হচ্ছে, লটারির টিকিট কেনার মত, লাভ ও লস দু’ই বেশি থাকে। অনেক সময় যেই শেয়ারের দাম বাড়তে থাকে সেই শেয়ার কিনেও লাভ করা যায়, যদি সঠিক কারনে কেনা যায়।

#৪। বিনিয়োগকৃত টাকা সঠিক ব্যবহার করা।

এটার গুরুত্ব আমি এক ঘন্টা কথা বললেও মনে হয় না শেষ হবে।

তবে এটা মানতেই হবে যে, টাকা শতভাগ সঠিক ব্যবহার করা সত্যি কঠিন।

আপনার বিনিয়োগকৃত টাকার মানি ম্যানেজমেন্ট করতে পারাটাই সঠিক ব্যবহার এর অংশ।

#৫। টাকা ক্যাশ রাখা

দেখতে খুব সোজা মনে হয় যে শেয়ার না কিনলেই তো হলো, তাহলেই তো টাকা ক্যাশ থেকে যাবে।

তবে একজন শেয়ার বাজার বিনিয়োগকারীর এটি একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ।

#৬। উচ্চ মূল্যে শেয়ার কিনতে ভয় না পাওয়া

অনেক সময় আমরা ভয়ের কারনে লাভ থেকে বঞ্ছিত হই। যেমন একটা শেয়ার অনেক দিন ২০ টাকা বা  ২১ টাকায় ছিল, হুট করে এটি ২২ টাকা ৫০ পয়সা চেলে গেল।

তখন আমাদের অনেকে এই ভাবে যুক্তি দেয় যে, এই শেয়ার ২০/২১ টাকায় কিনি নাই, তাহলে ২২ টাকা ৫০ পয়সায় কেন কিনবো?

এই যুক্তি ঠিক আছে তবে যদি কোম্পানির ভালো নিউজ থাকে যা এই শেয়াটির দাম আরো বাড়াতে সাহায্য করবে তাহলেই অল্প সময়ের জন্য অল্প পরিমান শেয়ার কেনা যেতে পারে।

#৭। ট্রেন্ডের বাইরে বিনিয়োগ করা

কথায় বলে, The Trend is Your Friend. শেয়ার বাজারে এই কথা ১০০ ভাগ সত্য। যখন যেই ট্রেন্ড এ মার্কেট চলে এই বাইরে গিয়ে খুব একটা ভালো করা যায় না।

তবে যারা কিছু কিছু সেক্টর কখনোই কেনা/বেচা করে না তাদের হুট করে এই ট্রেড ফলো করাও উতিচ হবে না।

মনে রাখতে আপনি সকল কোম্পানি বা সকল সেক্টর নিয়ে কাজ করতে পারবেন না, করলেও এর ফলাফল ভালো আসে না।

#৮। সুযোগ থাকলে স্টপ লস ব্যবহার করা

স্টপ লস আমাদের দেশে প্রচালন খুবই কম। তবে দক্ষ বিনিয়োগকারী বিশেষ করে যারা প্রতিদিন শেয়ার বাই/সেল করে তারা স্টপ লস বেশি ব্যবহার করে।

ধরুন ১০০ টাকা দিয়ে একটা শেয়ার কিনলেন এখন এর দাম কমে হলো ৯৮ টাকা, আপনি এনালাইসিস করে দেখলেন কিংবা একটা নিউজ আসলো যা কোম্পানির দামে আরো নেগেটিভ প্রভাব আসবে এই মুহূর্তে স্টপ দেওয়াই উত্তম। কেননা এই ২/৩% এর মায়া ত্যাগ করতে না পারলে লসের পরিমান আরো বাড়তেও পারে।

#৯। এভারেজ করে টাকা আটকে না রাখা

সাধারনত যারা লং টাইমের জন্য বাজারে বিনিয়োগ করে তাদের কেনা শেয়ারের দাম কমলে আরো শেয়ার কিনে গড় মূল্য কমিয়ে আনে।

আমাদের দেশে এটা খুবই কমন একটা জিনিষ। তবে যেই শেয়ারটা আপনি দাম করার পর এভারেজ করলেন, এখন যদি সেই দাম থেকে আরো কমে তাহলে এভারেজ না করাই উত্তম।

আপনি এভারেজ করবেন কি করবেন না এটা মূলত নির্ভর করবে কোন কোম্পানির শেয়ার কিনছেন এর উপর।

কোম্পানিটি যদি ফান্ডামেন্টালি ভালো হয়ে থাকে, এবং কোনো কারন ছাড়াই দাম কমে যায় তাহলে এভারেজ করলে লস পুষিয়ে লাভ করা যায়।

#১০। ভালো সুযোগ হাত ছাড়া হওয়ার পর ভুল দামে শেয়ার না কেনা

অনেক সময় আমরা অনেকে বুঝতে পারি, এই শেয়ারটা অল্প দিনের মধ্যে ১০/১২% প্রফিট দিবে।

অনেক সময় অনেকদিন ধরেই সেই শেয়ারটির দিকে নজর দেই, কিন্তু হুট করেই সেই শেয়ারটি এক দিনে ৫/৭% বা এর বেশি বেড়ে যায়, আর তখনই আমরা কিনি। ফল স্বরূপ, পরে আবার লসে পরে যাই।

তাই আপনি যেই দামে শেয়ারটি কিনবেন বলে ঠিক করেছেন, বিশেষ কোনো কারন না থাকলে সেই দামেই কেনার চেষ্টা করুন। যখন দাম বেড়ে যায় তখন না কেনাই উত্তম।

#১১। সেল টার্গেট ঠিক করা

ধরুন, আপনি শেয়ার বাজারে ১০ লাখ টাকা লং টাইমের জন্য বিনিয়োগ করতে চান।

এজন ১০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে কিছু মাস পরে আপনার ক্যাপিটাল সহ মুনাফা দাড়ালো ১৩ লাখ টাকা, এবং আপনি বিক্রি না করে বসে আছেন।

আবার কিছু মাস পর বেড়ে হলো ১৫ লাখ টাকা, এর কিছু মাস পর সেই টাকা কমে গেল, এবার দাড়ালো ১২ লাখ টাকা, আপনি ঠিক করলেন এবার ১৫ লাখ হলেই বিক্রি করবেন, কিন্তু এর কিছু মাস পর এর দাম দাড়ালো ৯ লাখ টাকা।

এই যে আপনি লাভ করার পর বিক্রি করতে পারলেন না, এর একমাএ কারন সেল টার্গেট ঠিক না করা।

তাই যখনই আপনি একটা শেয়ার কিনবেন, তখনই ঠিক করে রাখুন আপনি এই দাম পেলেই সেল দিবেন, এতে আপনি ভালো ফলাফল অর্জন করতে পারবেন।

#১২। ধৈর্য্য বাড়ানোর জন্য নিজেকে উৎসাহ দেওয়া

বিনিয়োগ মানেই ঝুঁকি, বিনিয়োগ মানেই অধিক মুনাফা। আপনি আর সাধারন ৫ জন বিনিয়োগকারীর মত না।

আপনার সাহস রয়েছে দেখেই শেয়ার বাজারে এসেছেন। এখানে টাকা, মেধা যেমন লাগে ঠিক তেমনি থাকতে হবে হার না মানা ধৈর্য্য।

মনে রাখবেন ধৈর্য্য ধারনের সাথে মানি ম্যানেজমেন্ট করতে পারলেই আপনি শেয়ার বাজারে ভালো কিছু অর্জন করতে পারবেন। নিজেকে আপনি উৎসাহ এভাবে দিতে পারেন, আমি যদি এই টাকা ব্যাংকে রাখতাম, ব্যাংক আমাকে ১ বছরে যা দিবে, শেয়ার বাজার আমাকে ১ দিনে তা দিতে পারে।

#১৩। নিউজ ভিত্তিক শেয়ার কেনা/বেচা না করা

শেয়ার বাজারে নিউজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তবে এটিই একমাএ লাভ করার উৎস না। আপনি যেই উৎস থেকে নিউজ পান না কেন তা যাচাই করতে হবে। যদি দেখেন আপনার যাচাইয়ের সাথে সব কিছু ঠিক আছে তখন সিদ্ধান্ত নিবেন, এর আগে না।

#১৪। দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে বিরত থাকা

আমরা অনেকেই আছি, একটা শেয়ার আজকে বিক্রি করলাম এবং কিছু টাকা লাভও করেছি, এরই মধ্যে ঐ দিনই আরেকটা শেয়ারে বিনিয়োগ করে বসে আছি।

ফলে নতুন যেই শেয়ারটি কিনলাম তা যাচাই বাছাই করার জন্য যথেষ্ট সময় দিলাম না, এর ফলে ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে।

তাই আমাদের উচিৎ হবে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখা।

#১৫। বিনিয়োগের ঝুঁকি বুঝতে পারা

কখনোই সব ডিম এক ঝুড়িতে রাখবেন না। ঝুড়ি একবার পড়ে গেলেই সব ডিম ভেঙ্গে যেতে পারে। আপনি যেই টাকা বিনিয়োগ করবেন সেই টাকা কত দিনের জন্য করবেন, কত টাকা লস হতে পারে ইত্যাদি বিষয়গুলো মাথায় রেখে ঝুঁকি নিরুপন করেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

#১৬। বাজার থেকে লাভের টাকা তোলা

আমরা অনেকেই লাভের টাকা সাথে সাথে বিনিয়োগ করি। এটা না করে আমাদের উচিৎ হবে, লাভের টাকা ৩ ভাগ করা। এক ভাগ টাকা মার্কেট থেকে তুলে নেওয়া, ১ ভাগ আলাদা ভাবে বিনিয়োগ করা এবং অন্যভাগ পুনরায় বিনিয়োগ করা।

#১৭। নিয়মিত মূলধন বাড়ানোর চেষ্টা করা  

শেয়ার বাজারে টাকা দিয়ে টাকা বানানো সহজ, একই সাথে বেশি টাকায় রিস্ক কম থাকে। আপনার মার্কেটে দক্ষতা বাড়ানোর সাথে সাথে উচিৎ হবে নিয়মিত মুলধন বাড়ানোর চেষ্টা করা।

এককালীন বিনিয়োগের পাশাপাশি মাসিক হিসাবে মূলধন বাড়াতে পারলে ৮০% বিনিয়োগকারির থেকে আপনার পোর্টফোলিওর স্বাস্থ্য ভালো থাকবে, ইনশা আল্লাহ! – কে এম চিশতি – ইউটিউব লিঙ্ক