সেনা সদস্য বা অফিসার হিসেবে কেমন হতে পারে ক্যারিয়ার?

সেনা সদস্য বা অফিসার হিসেবে ক্যারিয়ার!

আধুনিক পৃথিবীতে যত ধরনের পেশা আছে, তার মধ্যে সেনা সদস্য বা অফিসার হিসেবে কাজ করা সম্ভবত সবচেয়ে গৌরবের। ক্যারিয়ার অপশন হিসেবে এটি ইউনিক। মাতৃভূমির সার্বভৌমত্ব ও বৈদেশিক হুমকি থেকে জনগনকে সুরক্ষা দিতে প্রতিটি দেশ নিজস্ব সেনাবাহিনী গড়ে তোলে।

সেখানে যোগ দেয়ার সুযোগ পায় দেশের সবচেয়ে মেধাবী ও শারীরিকভাবে সামর্থ্য তরুন-যুবকেরা। সুশৃঙ্খল জীবন, দেশের স্বার্থে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য সদা প্রস্তুত সুসজ্জিত পোশাকের আড়ালে আছে অন্যরকম এক আভিজাত্য ও ঐতিহ্য।

একজন সেনা সদস্য বা সেনা অফিসার হিসেবে আপনার ভবিষ্যৎ কেমন হতে পারে তা’ই আমাদের আজকের আলোচ্য বিষয়।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সশস্ত্র বাহিনীর সবচেয়ে বৃহৎ ও স্থল শাখা। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে অফিসার এবং সৈনিকসহ প্রায় ২২৫০০০০ সদস্য নিযুক্ত আছেন।

স্বাধীনতা যুদ্ধের পরই ১৯৭১ সাল থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বাংলাদেশ সরকারের সামরিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সক্রিয়।

সামরিক সক্ষমতার পাশাপাশি যেকোনো দুর্যোগ মোকাবেলা, জরুরি অবস্থা ও বড় বড় নির্মাণকাজে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দক্ষতার পরিচয় দিয়ে আসছে।

সেনাবাহিনীর পদবিন্যাস ও সরকারি মর্যাদা

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে তিন ধরনের পদবিন্যাস রয়েছে-

  • কমিশন্ড অফিসারঃ বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমীতে কমিশন প্রদান করা হয়। একজন কমিশনপ্রাপ্ত অফিসার বাংলাদেশ গণপ্রজাতন্ত্রী সরকারের প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পান।

অফিসারগনের পদমর্যাদার ক্রম নিম্নরূপ –

লেফটেন্যান্ট < ক্যাপ্টেন < মেজর < লেফটেন্যান্ট কর্নেল < কর্নেল < বিগ্রেডিয়ার জেনারেল < মেজর জেনারেল < লেফটেন্যান্ট জেনারেল < জেনারেল

  • জুনিয়র কমিশন্ড অফিসারঃ জুনিয়র কমিশন্ড অফিসাররা বাংলাদেশ সরকারের প্রথম শ্রেণীর(নন-ক্যাডার) গেজেটেড কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেন।

জুনিয়র কমিশন্ড অফিসারগনের পদমর্যাদার ক্রম নিম্নরূপ –

ওয়ারেন্ট অফিসার < সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার < মাষ্টার ওয়ারেন্ট অফিসার < অনারারি লেফটেন্যান্ট < অনারারি ক্যাপ্টেন

  • নন কমিশন্ড অফিসার ও সৈনিকঃ নন কমিশন্ড অফিসারদের মধ্যে সার্জেন্ট দ্বিতীয় শ্রেণীর এবং সৈনিক, ল্যান্স কর্পোরাল এবং কর্পোরালরা তৃতীয় শ্রেণীর গেজেটেড পদবী অধিকৃত।

 

সেনা অফিসার হিসেবে ক্যারিয়ার কেন সবার প্রথম পছন্দ?

প্রাচীনকাল থেকেই সবচেয়ে চৌকশ ও নেতৃত্বদানে যোগ্য জনবল সেনা কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পেত। রাজপরিবারের সদস্যদের সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োগের ঐতিহ্য এখনো অনেক দেশে বর্তমান।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও সেনাবাহিনীর কমিশন্ড অফিসার হওয়া সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ পেশা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

  • সেনা অফিসার হিসেবে কমিশন লাভ করা আভিজাত্য ও মর্যাদার প্রতীক।
  • দেশ সেবা ও দেশের সবচেয়ে দক্ষ বাহিনীর নেতৃত্বদানের সুযোগ পাওয়া যায়।
  • রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সুযোগসুবিধা, ক্ষমতা ও সম্মান লাভ করা যায়।
  • বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সবচেয়ে দুর্নীতিমুক্ত, স্বচ্ছ ও দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান হিসেবে জনগনের আস্থার প্রতীক।
  • অবসরের পরও সরকারি-বেসরকারি বড় বড় প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদে চাকরি করার সুযোগ রয়েছে।
  • জাতিসংঘের বিভিন্ন মিশনে নেতৃত্ব দেয়ার সুযোগ রয়েছে।
  • অবসরের পর বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুযোগ রয়েছে।
  • বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়ে সক্রিয় রাজনিতিতে ভূমিকা রেখে দেশ সেবা করার সুযোগ থাকে।
  • প্রশিক্ষিত, সুশৃঙ্খল, রোমাঞ্চকর ও বিভিন্ন পরিবেশে দক্ষতার পরিচয় দিয়ে অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ একটা জীবনের পথ উন্মোচিত হয়।
  • সরকারি তদারকিতে পরিবার ও সন্তানদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা হয়।

সেনা অফিসার/সৈনিক হিসেবে নিয়োগের যোগ্যতা

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে সৈনিক, জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার(জেসিও) ও কমিশন্ড অফিসার হিসেবে নিয়োগের প্রক্রিয়া আলাদা।

একজন সৈনিকের নিয়োগের ক্ষেত্রে –

শিক্ষাগত যোগ্যতাঃ পুরুষদের ক্ষেত্রে এসএসসি বা সমমান পরীক্ষায় জিপিএ ৩.৫ থাকতে হবে। নারীদের ক্ষেত্রে বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি পাশ হলেই চলবে।

বয়সঃ ১৭-২০ বছর

উচ্চতা ও ওজনঃ পুরুষ প্রার্থীদের জন্য কমপক্ষে ৫ ফুট ৬ ইঞ্চি এবং ওজন ৫০ কেজি। এছাড়া বুকের মাপ স্বাভাবিক অবস্থায় ৩০ ইঞ্চি ও প্রসারিত অবস্থায় ৩২ ইঞ্চি থাকতে হবে।

আর নারীদের ক্ষেত্রে উচ্চতা কমপক্ষে ৫ ফুট ২ ইঞ্চি এবং ওজন ৪৭ কেজি থাকতে হবে। বুকের মাপ স্বাভাবিক অবস্থায় ২৮ ইঞ্চি ও প্রসারিত অবস্থায় ৩০ ইঞ্চি থাকতে হবে।

প্রার্থীদের অবশ্যই অবিবাহিত ও সাঁতার জানতে হবে।

নির্বাচন প্রক্রিয়াঃ

সেনাবাহিনীতে সৈনিক নির্বাচন প্রক্রিয়া কয়েকটি ধাপে হয়ে থাকে। প্রার্থীদের প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা, লিখিত পরীক্ষা ও মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে। এসব পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের চূড়ান্তভাবে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়।

নির্বাচিত প্রার্থীদের দুই বছরের জন্য সামরিক প্রশিক্ষন দেয়া হয়। এ অবস্থায় প্রার্থীরা এইচএসসি বা উচ্চতর পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পান।

জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার হিসেবে নিয়োগের ক্ষেত্রে-

শিক্ষাগত যোগ্যতাঃ স্নাতক বা সমমান। স্নাতকে কমপক্ষে সিজিপিএ ২.০০ এবং এসএসসি ও এইচএসসি/সমমানে কমপক্ষে জিপিএ ৩.০০ থাকতে হবে।

বয়সঃ ২০-২৮ বছর

উচ্চতা ও ওজন সৈনিক পদের মতোই। সাঁতার জানা ও অবিবাহিত থাকা বাধ্যতামূলক।

কমিশন্ড অফিসার হিসেবে নিয়োগের ক্ষেত্রে-

সেনাবাহিনীতে নিয়োগের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা, ফিটনেস ও যোগ্যতার প্রমান দিতে হয় কমিশন্ড অফিসার হতে।

শিক্ষাগত যোগ্যতাঃ কমপক্ষে এইচএসসি পাশ হতে হবে। এসএসসি ও এইচএসসি এর একটিতে জিপিএ ৫.০০ ও অন্যটিতে কমপক্ষে ৪.৫ থাকতে হবে।

ইংলিশ মিডিয়ামের ক্ষেত্রে ও-লেভেলে ৬টি সাবজেক্টের মধ্যে কমপক্ষে তিনটিতে এ-গ্রেড ও তিনটিতে বি-গ্রেড থাকতে হবে। এ-লেভেলের দুইটি বিষয়ের মধ্যে দুইটিতেই বি-গ্রেড থাকতে হবে।

বয়সঃ সাধারণ প্রার্থীদের ১৭-২১ বছর, সশস্ত্র প্রার্থীদের ক্ষেত্রে ১৮-২৩ বছর।

উচ্চতা ও ওজনঃ ছেলেদের উচ্চতা কমপক্ষে ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি বা ১.৬৩ মিটার। মেয়েদের ৫ ফুট ২ ইঞ্চি বা ১.৫৭ মিটার।

ছেলেদের ওজন কমপক্ষে ৫৪ কেজি, মেয়েদের ৪৭ কেজি। বুকের মাপ স্বাভাবিক অবস্থায় ছেলেদের কমপক্ষে ৩০ ইঞ্চি ও প্রশস্ত অবস্থায় ৩২ ইঞ্চি, মেয়েদের তা যথাক্রমে ২৮ ইঞ্চি ও ৩০ ইঞ্চি।

নির্বাচনের ধাপসমূহঃ

কমিশন লাভের পূর্বে প্রথমে প্রার্থীকে প্রিলিমিনারি লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়।

লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণর পর একটি ছোট মৌখিক পরীক্ষা নেয়া হয়।

মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর আইএসএসবি(ISSB) বা চূড়ান্ত পরীক্ষা নেয়া হয়।

এটি সবথেকে কঠিন ধাপ। এসময় প্রার্থীর বুদ্ধিমত্তা, নেতৃত্বগুণ, কৌশলগত দক্ষতা, আত্মবিশ্বাস, শারীরিক সামর্থ্য পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই করা হয়। ISSB তে উত্তীর্ণ হবার পর প্রায় ৩ বছরের প্রশিক্ষনের জন্য পাঠানো হয়।

কঠিন প্রশিক্ষন ও পরিপূর্ণ দক্ষতা অর্জন শেষে একজন প্রার্থীকে লেফটেন্যান্ট হিসেবে কমিশন প্রদানের জন্য সুপারিশ করা হয়।

সেনাবাহিনীতে সুযোগ সুবিধা ও পদোন্নতি

সৈনিক পদে নিয়োগপ্রাপ্তরা সরকারের নির্ধারিত স্কেলে বেতন-ভাতা, বিনা খরচে উচ্চশিক্ষা, আহার, পেনশন, বাসস্থান, চিকিৎসা খরচ ও সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ পাবেন।

জাতিসংঘের মিশনে কাজ করার সুযোগ আছে।

একজন সৈনিক দক্ষতা ও যোগ্যতার প্রমানের ভিত্তিতে সার্জেন্ট বা অফিসার হিসেবে পদোন্নতি পেতে পারেন।

সেনাবাহিনীর কমিশন্ড অফিসাররা সরকারের প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা মর্যাদা পান।

তাদের বেতন ভাতা অনেকটা বেসামরিক প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তাদের অনুরুপ।

তবে তারা সরকারের বিভিন্ন রেশন সুবিধা ভোগ করেন।

জাতিসংঘের মিশনে কাজ করলে আরও বাড়তি বেতন পাওয়া যায়। অবশরপ্রাপ্ত অফিসাররা সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বড় বড় উচ্চপদে চুক্তিতে নিয়োগ পেতে পারেন।

একজন লেফটেন্যান্ট থেকে ক্যাপ্টেন হতে মোট তিনটি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। এতে সময় লাগে ২-৩ বছর। ক্যাপ্টেন থেকে মেজর হতে সময় লাগে তিন বছর।

পরবর্তী পদোন্নতিগুলোর ক্ষেত্রে কোন বাঁধা ধরা নিয়ম নেই। যোগ্যতা ও দক্ষতার প্রমানে তা হয়ে থাকে। আরো পড়ুন – ক্যারিয়ার হিসেবে মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং কেমন হতে পারে

পরিশেষে, সেনাবাহিনীতে ক্যারিয়ার হতে পারে সবচেয়ে সফলতা, অর্জন ও অহঙ্কারের স্বাক্ষর। যেসকল তরুন-যুবক অথবা অভিভাবকরা তাদের সন্তানের ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবছেন, তাদের জন্য সেনাবাহিনীর একজন গর্বিত সদস্য হতে পারে সবচেয়ে পছন্দের বিকল্প। কিন্তু এজন্য চাই সঠিক প্রস্তুতি ও অধ্যবসায়।