সঞ্চয় কী – কেন সঞ্চয় করবেন?

সঞ্চয় নিয়ে বিস্তারিত ধারনা

সঞ্চয় কি কেন সঞ্চয় করবেন

সঞ্চয় কি কেন সঞ্চয় করবেন

সঞ্চয় আমাদের কাছে অতি পরিচিত একটি শব্দ। আপনি যদি ১০০ জন মানুষকে সঞ্চয়ের প্রয়োজনীয়তা আছে কি না তা জিজ্ঞাসা করেন তাহলে ৯৯ জনই বলবে অবশ্যই প্রয়োজন আছে। কিন্তু আমরা কতজন নিয়মিত সঞ্চয় করতে পারি?

সঞ্চয়ের গুরুত্ব শুধু জানলেই হবে না, এই জানাকে যখন কাজে লাগানো যায় সেখানেই প্রকৃত সার্থকতা। আমি জানি সঞ্চয় করা ভালো কিন্ত বিপদের দিনে দেখলাম আমার কাছে কোন কানাকড়িও নেই, এই জানা থেকে বরং না জানাই ভালো।

এটা সত্যি যে, জীবনের অনেক কিছু আমরা বিপদে পড়লে শিখি কিন্তু শেখাটা যেন এমন সময় না হয় যখন আফসোস করা ছাড়া আমার কাছে কোন পথ খোলা থাকা না।

সঞ্চয়ের প্রয়োজনীয়তা বলে শেষ করা যাবে না, তবে বাস্তব জীবনে এর যথাযথ প্রয়োগ না করতে পারলে সবটাই শূণ্য।

জীবনে সুযোগ বার বার আসে না। তাই সুযোগ থাকতেই চেষ্টা করতে হবে সর্বোচ্চ।

সঞ্চয়ের একটি সাধারণ সংজ্ঞা দিয়ে শুরু করি।

সঞ্চয়ের সংজ্ঞা – আয়ের যে অংশ আপনার বর্তমানে খরচ হচ্ছে না, ভবিৎষতের জন্য তোলা থাকছে তাই সঞ্চয়।

ভবিৎষতের জন্য যা সংরক্ষিত তাই সঞ্চয়। সাধারণত আয় থেকে ব্যয় বাদ দিয়ে যা থাকে, তাই সঞ্চয় হিসাবে ধরা হয়। ’আয়-ব্যয়=সঞ্চয়’।

কিন্তু আপনি যদি প্রকৃতই আপনার সঞ্চয়কে নিয়মিত করতে চান তবে আপনাকে চলতে হবে সম্পূর্ণ উল্টো নিয়মে।

আপনি তখন ’আয়-সঞ্চয়=ব্যয়’ এই পদ্ধতি অনুসরণ করবেন। আপাতত দৃষ্টিতে এটি কঠিন মনে হলেও এটিই সঠিক পদ্ধতি হবে আপনার নিয়মিত সঞ্চয়ের জন্য।

দৈনন্দিন জীবনে, অভাব আমাদের নিত্য দিনের সঙ্গী। যে লোক ১৫০০০ হাজার টাকা আয় করেন তার যেমন অভাব আছে, যে মাসে ১ লাখ টাকা আয় করে তারও কিছু না কিছু অভাব আছে।

আবার চিন্তা করুন, আপনি ২০,০০০ টাকায় সংসার চালাচ্ছেন গত একবছর। আপনার আয় বেড়ে ২৫,০০০ টাকা হয়েছে।

তাহলে বাড়তি এই ৫,০০০ টাকা আপনার সঞ্চয় হওয়া উচিত। কিন্তু আমরা কি পারি সেটা সঞ্চয় করতে? পারি না।

চোখের নিমিষেই কখন যে আমার সংসার খরচ বেড়ে ২৫,০০০ টাকা হয়ে যায় আমরা বুঝতেও পারি না।

তাহলে খরচের আগেই যদি আমি সঞ্চয়ের টাকা আলাদা করে রাখি এবং বাকি টাকা খরচ করি তাহলে নিয়মিত সঞ্চয় করা সম্ভব।

আপাতত দৃষ্টিতে একটু কঠিন মনে হলেও অসম্ভব কিছু না।

তবে দৃঢ় থাকতে হবে, কোন ভাবেই আমি সঞ্চিত অর্থ থেকে অপ্রয়োজনে বা বিলাসিতার জন্য টাকা খরচ করবো না। কয়েক মাসের মধ্যেই এটি আপনার অভ্যাসে পরিণত হবে।

অর্থনীতিক দৃষ্টিকোণে মানুষ তার আয়ের ২০ থেকে ২৫ শতাংশ নিয়মিত সঞ্চয় করা উচিত।

একজনের মাসিক আয় যদি ২ লাখ টাকা এবং অন্যজনের আয় যদি ৫০,০০০ টাকা হয়, তাদের সঞ্চয়ের পরিমান সমান হবে না।

সুতরাং অন্যের সাথে তুলনা করে হতাশ হবেন না।

সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে আপনি আপনার জায়গা থেকে কি করতে পারছেন তার দিকে মনযোগী হন।

সঞ্চয়ের বয়স

সঞ্চয়ের আসলে কোন বয়স হয় না। মনে করে দেখুন, ছোটবেলায় মা-বাবা আমাদের মাটির ব্যাংক কিনে দিতেন সঞ্চয়ের জন্য।

অর্থ্যাৎ, শিশুকাল থেকেই আমদের সঞ্চয়ের জন্য শিক্ষা দেওয়া হয়। আপনার আয় যেমনই হোক না কেন, সঞ্চয় শুরু করুন।

কোন একদিন করবো বা বেতন বেশি হলে করবো, সেই চিন্তা মাথা থেকে বাদ দিন। এখনই সঞ্চয় শুরু করুন।

আপনি একমাস বেশি সঞ্চয় করতে পারলে সেটা আপনার জন্যই লাভজনক।

যাদের কোন আয় নাই অর্থ্যা শিশুরাও কিন্তু নিয়মিত টিফিনের টাকা জমিয়ে সঞ্চয় করে, তাহলে আপনি কেন করবেন না?

একটি বিষয় চিন্তা করুন, কেউ যখন আমাদের ব্যবসার কথা বলে তখন আমরা ভাবি, পুঁজি কোথায় পাবো? আমার টাকা নাই।

কিন্তু যদি আজ আপনার সঞ্চিত অর্থ থাকত তবে আপনি ব্যবসার কথা ভাবতে পারতেন এবং আয়ের আরো একটি উৎস তৈরী করতে পারতেন।

চলুন একটি হিসাব করি। ধরুন, এক ব্যক্তি দিনে ১০টি সিগারেট খায়, যদি প্রতিটি সিগারেটের মূল্য ১১ টাকা হয় তবে দৈনিক ১১০ টাকা খরচ এবং মাসে ৩,৩০০ টাকা খরচ।

তাহলে বছরে ৩৯,৬০০ টাকা খরচ। বছরে তিনি প্রায় ৪০,০০০ টাকা খরচ করেন সিগারেটের পিছনে এবং শারীরিক ক্ষতি তো করছেনই।

আমরা বলছি না আপনার ব্যক্তিগত সব ইচ্ছে, ভালো লাগা বাদ দিয়ে দিন। তবে দিন শেষে হিসাব করতে ভুলবেন না আপনি কোথায় কিভাবে খরচ করছেন।

আবার ফিরে যাই পুরোনো প্রসঙ্গে। আজ ৫ বছর চাকরি করার পর যদি আপনার কাছে ব্যবসা করার সামান্যকোন মূলধন না থাকে তার জন্য কিন্তু শুধুমাত্র আপনার লাগামহীন খরচ দায়ী নয়, আপনিও দায়ী।

একথা সত্যি সঞ্চয় না করলে, কেউ আপনাকে কিছু বলবে না, সে অধিকারও কারো নাই। কিন্তু বিপদের দিনে যখন কারো কাছে আপনার হাত পাততে হবে না, তখন আপনি বুঝতে পারবেন সঞ্চয়ের মূল্য।

সময় থাকতেই পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। বাস্তব জীবনে একটা ছোট পরীক্ষা করে দেখতে পারেন নিজের সাথে।

আপনি কারো কাছ থেকে ৫০০ টাকা ধার চান এবং বলুন ১ সপ্তাহ পর আপনি টাকা ফেরত দিবেন। ১ সপ্তাাহ পর টাকা আপনি ফেরত দিবেন না, আরো ১ সপ্তাহ অপেক্ষা করে টাকা ফেরত দিবেন।

লক্ষ্য করলে দেখবেন, তার সাথে আপনার সম্পর্ক একটু বদলে গেছে। সে মুখে কিছু বলবে না হয়তো কিন্তু আচরণে সেটি প্রকাশ পাবে।

তাহলে ভেবে দেখুন, আপনি যদি টাকা ফেরত দিতে অসমর্থ হতেন তাহলে কি করতেন? এই উদাহরণ হয়তো সকল ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, তবে বাস্তব চিত্রটি খুব একটা ভিন্ন নয়।

কেন আপনি সঞ্চয় করবেন

১। বিপদের দিনে সঞ্চয় আপনার বন্ধু।

বিপদের দিনে আপনি যেমন বিশস্ত একটি শক্ত হাত চান নিজের পাশে, সঞ্চয়ও ঠিক তেমনি একটা বিশস্ত হাত আপনার জন্য। সঞ্চয়ের কারণেই বিপদের দিনে আপনি ঘাবড়ে যাবেন না।

২। সঞ্চয় আপনার মনোবল বাড়িয়ে দিবে কয়েক গুণ।

যখন আপনার খরচের অতিরিক্ত টাকা হাতে থাকবে, নিজের অজান্তেই আপনি অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী অনুভব করবেন।

আরোও পড়ুন – টাকা জমানোর সেরা কিছু কৌশল

৩। আয়ের আরো একটি উৎস হতে পারে সঞ্চয়।

কেননা আজকের এই সঞ্চয় আপনাকে আগামী দিনে বিনিয়োগ করতে সাহায্য করবে।

৪। সঞ্চিত অর্থ দিয়ে আপনি ব্যবসা করতে পারেন।

ব্যবসার মূলধন যদি আপনার কাছে থাকে, তখন দেখবেন অনেক অনেক আইডিয়া আসছে ব্যবসা করার। টাকা ব্যবসার জন্য অনেক বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

সেখানে আপনার কাছে যদি টাকা থাকে, তাহলে চাকরির পাশাপাশি ব্যবসা করেও আপনি লাভবান হতে পারেন। কোন বুদ্ধিমান মানুষই আয়ের একটি উৎস রাখতে চাইবে না।

৫। অনাকাংক্ষিত ঘটনা 

অনাকাংক্ষিত নানা ঘটনা আমাদের জীবনে যেমন ঘটে, ঠিক তেমনি নানা রকম অনাকাংক্ষিত খরচ হয়। টালমাটাল সেই খরচগুলো সামাল দিতে এবং স্বাভাবিক জীবনযাপন নিরবিচ্ছিন্ন রাখতে সঞ্চয়ের কোন বিকল্প নেই।

আপনি জানেন কি? – যে ১০টি অভ্যাস গরিবকে আরো গরিব বানায়

#৬। অবসর জীবন

আমাদের সবাইকে একদিন অবসর জীবনে যেতে হবে। ব্যবসায়ীদের জন্য এটি বাধ্যতামূলক না হলেও, চাকুরিজীবীদের জন্য এ যেন চির সত্য। অবসর জীবনে সুখী ও বর্তমান সময়ের মতো সাবলীল জীবন কাটানোর জন্য আপনাকে সঞ্চয় করতেই হবে।

ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালুকণা; বিন্দু বিন্দু জল, গড়ে তোলে মহাদেশ, সাগর অতল’। আজ আপনার বিন্দু বিন্দু সঞ্চিত অর্থ, একদিন বটবৃক্ষের মতই আপনাকে ছায়া দিবে।

করোনা কালীন এই মহামারীর কথা চিন্তা করুন, ছাঁটাই হচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। এই বিপদের দিনে লকডাউনে আটকা পড়া অসংখ্য মানুষের একমাত্র অবলম্বন সঞ্চয়।

যাদের সেই সম্বলও নেই, তাদের কষ্ট সহজেই অনুমানযোগ্য। তাই সময় থাকতে আজ, এখনই সচেতন হোন। একটি সঠিক সিদ্ধান্ত বদলে দিতে পারে আপনার গোটা জীবন।