ক্যারিয়ার হিসেবে মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং কেমন হতে পারে
ক্যারিয়ার হিসেবে মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং কেমন হতে পারে?

ক্যারিয়ার হিসেবে মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং
ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবনা সবার জীবনেই আসে, আগে কিংবা পরে। জেনারেল লাইনে পড়াশোনা করে একসময় দেখা যায় তুমুল প্রতিযোগিতার চাকরির বাজারে নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া কঠিন। তখন মনে হয় আহা, কেন এই সাবজেক্ট নিয়ে পড়লাম, কেন ওইটা নিয়ে পড়লাম না।
সচেতন ও উদ্যমী তরুন-যুবকরা স্কুলজীবন থেকেই ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবেন। তারা চেষ্টা করেন গতানুগতিক চিন্তাধারা থেকে বেড়িয়ে বিশেষ কোন সাবজেক্ট বেঁছে নিতে যার মার্কেটে চাহিদা অনেক, আয় বেশি, উপভোগ্য এবং মর্যাদার। মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং হতে পারে তেমন এক কাঙ্ক্ষিত পেশা। আজকের লেখা মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে।
মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং কি?
মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং মূলত সামুদ্রিক জাহাজ সম্পর্কিত। আধুনিক বিশ্বে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক পণ্য সরবরাহের ৯০ শতাংশ হয় শিপিং ইন্ডাস্ট্রির মাধ্যমে। মেরিন ইঞ্জিনিয়াররা মূলত এসব জাহাজের বিভিন্ন যান্ত্রিক দিকগুলো দেখভাল করেন।
আর একশো বছর আগেও মানুষের কাছে মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং কি, সে বিষয়ে কোন ধারণা ছিলনা। কিন্তু বর্তমানে অন্যান্য প্রথম সারির পেশার মতোই মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং সুপরিচিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত।
একজন মেরিন ইঞ্জিনিয়ার এমন একজন পেশাদার যিনি সমুদ্র প্রকৌশল বা মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করেছেন এবং জাহাজের সকল যান্ত্রিক সরঞ্জাম পরিচালনা, রক্ষণাবেক্ষণ এবং মেরামতের দায়িত্ব পালন করেন।
জাহাজে বেশ কিছু যান্ত্রিক সিস্টেম রয়েছে- যেমন, প্রপালশন মেকানিক্স, বিদ্যুৎ সিস্টেম, বিদ্যুৎ উৎপাদন সিস্টেম, লুব্রিকেশন, ফুয়েল সিস্টেম, লাইটিং এবং শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ইত্যাদি। একজন মেরিন ইঞ্জিনিয়ার এসব বিষয়গুলো দেখভাল করে জাহাজ পরিচালনায় সহায়তা করেন।
মেরিন ইঞ্জিনিয়ারদের কাজঃ
মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিংকে পেশা হিসেবে গ্রহনের আগে ইঞ্জিনিয়ারদের কাজ সম্পর্কে জানা জরুরি।
- বিভিন্ন যান্ত্রিক সিস্টেম পর্যবেক্ষণ এবং রক্ষণাবেক্ষণ – একটি জাহাজে বিভিন্ন পদমর্যাদার সমন্বয়ে ইঞ্জিনিয়ারদের একটি টিম থাকে। টিমের প্রত্যেক সদস্যকে জাহাজের বিভিন্ন যান্ত্রিক সিস্টেমের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব বণ্টন করা হয়। প্রত্যেক প্রকৌশলীর দায়িত্ব তার সিস্টেম সঠিকভাবে নিরবিচ্ছিন্ন কাজ করছে কিনা তা নিশ্চিত করা।
- ফুয়েল অয়েল বাঙ্কারিং – মেরিন ইঞ্জিনিয়াররা বাঙ্কার স্টেশন বা বার্জ থেকে জাহাজে জ্বালানি তেল স্থানান্তর করেন।
- বন্দরের কাজ – জাহাজ বন্দর ত্যাগ বা নোঙরের সময় বিভিন্ন টেকনিক্যাল দিকগুলো, আবহাওয়া ও দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য পদক্ষেপ গ্রহন।
- জরুরী মেরামত – জাহাজের কোন যন্ত্রপাতি ক্ষতিগ্রস্থ হলে তা মেরামত করার দায়িত্ব পালন করতে হয়।
- অফিসিয়াল রেকর্ড কিপিং – জাহাজের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র রক্ষনাবেক্ষন, ইঞ্জিনজনিত বিভিন্ন রেকর্ড, ন্যাভিগেশন ইত্যাদির দেখভালের জন্য ডেক ক্যাডেট বা অফিসার থাকেন।
- রেডিও অ্যান্ড ওয়্যারলেস কমিউনিকেশন – এই বিভাগের কর্মীরা সকল প্রকার যোগাযোগ ব্যাবস্থা নিয়ন্ত্রণ করেন।
এসব দায়িত্ব ছাড়াও জাহাজে একজন মেরিন ইঞ্জিনিয়ারকে জাহাজের ইঞ্জিন রুম বিভাগের প্রধান প্রকৌশলীর নির্দেশনাবলী অনুসরণ করতে হয়।
কেন মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হবেন?
- চাকরির বাজারে মেরিন ইঞ্জিনিয়ারদের চাহিদা অনেক
- উচ্চ বেতনে চাকরির সুযোগ পাওয়া যায়
- রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার সুযোগ
- আন্তর্জাতিক বাজারে ভালো মূল্যায়ন রয়েছে
- অন্যান্য সাবজেক্টের তুলনায় পড়াশোনার খরচ কম
শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জন
বাংলাদেশে বেশ কিছু সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানো হয়। এসব প্রতিষ্ঠানে সাধারণত ৪ বছর ও ২ বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা কোর্স পড়ানো হয়। সুযোগ পেতে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়।
অন্যরা যা পড়ছে – পেশা হিসেবে ফিজিওথেরাপি কেমন
বাংলাদেশ মেরিন একাডেমীতে আবেদনের যোগ্যতাঃ
- প্রার্থীর সর্বোচ্চ বয়স থাকতে হবে ২১ বছর
- বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি শেষ করতে হবে
- উভয় পরীক্ষায় কমপক্ষে জিপিএ ৩.৫ থাকা চাই
- এইচএসসিতে অবশ্যই পদার্থ বিজ্ঞান ও উচ্চতর গনিতে ৩.৫ এবং ইংরেজিতে ৩.০০ থাকতে হবে
- উচ্চতা পুরুষদের জন্য কমপক্ষে ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি ও মহিলাদের জন্য ৫ ফুট দুই ইঞ্চি থাকতে হবে।
- ওজন ও চোখের দৃষ্টি স্ট্যান্ডার্ড থাকতে হবে
- অবিবাহিত থাকা ও সাঁতার জানা বাধ্যতামূলক
পরীক্ষা পদ্ধতিঃ প্রথমে ১০০ নাম্বারের লিখিত পরীক্ষা নেয়া হয়(পদারথ-২৫, উচ্চতর গনিত-২৫, ইংরেজি-২৫, বাংলা-১০ ও সাধারন জ্ঞান-১৫)। লিখিত পরীক্ষায় পাশ মার্ক থাকে ৪০। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের শারীরিক পরীক্ষা ও ভাইবা হয়।
আসন সংখ্যাঃ মোট আসন ৭৬৩। যেখানে সরকারি ৪০০ এবং বেসরকারি ৩৬৩। মেয়েদের জন্য ২৫ টি আসন কোটা হিসেবে থাকে।
পড়াশোনার খরচঃ সরকারিভাবে সুযোগ পেলে ৫০-৭০ হাজার খরচ হতে পারে। বেসরকারিভাবে ৪ থেকে ৫ লাখ খরচ লাগবে।
ক্যারিয়ার ও চাকরির ভবিষ্যৎঃ
সারা বিশ্বেই মেরিন ইঞ্জিনিয়ারদের অনেক চাহিদা। আমাদের দেশে বাংলাদেশ শিপবিল্ডিং কর্পোরেশন, খুলনা শিপইয়ার্ড, ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড ও ডকইয়ার্ডে মেরিন ইঞ্জিনিয়ারদের যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। এছাড়াও বাংলাদেশ নেভি, বিআইডব্লিউটিএ, বিআইডব্লিউটিসি ইত্যাদি সরকারি প্রতিষ্ঠানসমুহে রয়েছে মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে ক্যারিয়ার গড়ার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ।
কর্মক্ষেত্রে পদবীঃ
একটি জাহাজ পরিচালনা ও একটি সফর সম্পন্ন করতে যেসকল ব্যাবস্থাপনা প্রয়োজন হয় তাকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। তারা হল যথাক্রমে ডেক বা নটিক্যাল এবং ইঞ্জিন।
দুই ক্ষেত্রেই ক্যাডেট হিসেবে সাধারণ নিয়োগ দেয়া হয়।
ডেক বা নটিক্যাল বিভাগের পদবিন্যাস যথাক্রমে- ডেক ক্যাডেট, ৪র্থ মেট, ৩য় মেট, ২য় মেট চীফ মেট এবং ক্যাপ্টেন।
আবার ইঞ্জিন বিভাগের পদবিন্যাস যথাক্রমে- ইঞ্জিন ক্যাডেট, ৫ম ইঞ্জিনিয়ার, ৪র্থ ইঞ্জিনিয়ার, ৩য় ইঞ্জিনিয়ার, ২য় ইঞ্জিনিয়ার এবং চীফ ইঞ্জিনিয়ার।
প্রতিটি পদোন্নতির জন্য আলাদা আলাদা পরীক্ষায় অংশ নিয়ে উত্তীর্ণ হতে হয়।
বেতন ও উপার্জন
শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জন ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষনের পর মেরিন ইঞ্জিনিয়ারদের বেকার থাকার কোন সুযোগ নেই।
তবে বহুমুখী কর্মক্ষেত্র বিধায় আয়-রোজগারের বিষয়টি অনেকটা প্রতিষ্ঠান, পদবী ও অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে।
একজন মেরিন ইঞ্জিনিয়ার তার পেশাগত জীবনে ২০ হাজার থেকে শুরু করে ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত মাসিক বেতন পেতে পারেন।
উচ্চশিক্ষাঃ দেশে মেরিন ইঞ্জিনারিং শেষ করে উচ্চশিক্ষার জন্য স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে পড়াশোনা করা যায়। আমাদের দেশে বুয়েটে এমএস/এমএসসি ও পিএইচডি কোর্স চালু আছে।
মেরিন ইঞ্জিনিয়ারদের লাইফস্টাইল
মেরিন ইঞ্জিনিয়ারদের বছরের একটা বড় সময় সমুদ্রে কাটানো হয়। একজন ভ্রমন পিপাসু মানুষের জন্য এই পেশা উপভোগ্য। মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হবার সুবাদে বিভিন্ন দেশে ভ্রমনের সুযোগ মেলে।
সমুদ্রের স্বাস্থ্যকর আবহাওয়া এবং ফ্রেশ খাবার শরীর ও মনের জন্য বিশেষ অনুকূল। সাধারণত একজন ইঞ্জিনিয়ার দুই শিফটে চার ঘণ্টা করে কাজ করেন। তবে প্রতিষ্ঠানভেদে শিফটের পার্থক্য থাকতে পারে।
পরিশেষেঃ যারা অ্যাডভেঞ্চার ও সমুদ্র ভালোবাসেন তাদের জন্য মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং সবচেয়ে পারফেক্ট একটা পেশা। বর্তমান বিশ্বে এর চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ ও সম্ভাবনাময় ক্যারিয়ার এটি হতে পারে আপনার কাঙ্ক্ষিত পেশা।