উদ্যোক্তা হতে চাইলে কি ডিগ্রি প্রয়োজন?

উদ্যোক্তা হতে চাইলে কি ডিগ্রি প্রয়োজন?

উদ্যোক্তা হতে চাইলে কি ডিগ্রি প্রয়োজন

উদ্যোক্তা হতে চাইলে কি ডিগ্রি প্রয়োজন

ছোটবেলায় আমাদের যখন জিজ্ঞেস করা হত বড় হয়ে কি হতে চাই, আমরা প্রায়ই সবাই বলতাম ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হতে চাই। কেউবা আবার পাইলট কিংবা বিজ্ঞানী হতে চাইতো। এর বাইরে তেমন খুব একটা বেশি, কেউ কিছু বলতাম না।

এর কারন ছোটবেলায় আমাদের মধ্যে এমন চিন্তা ভাবনাই ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। বড় হয়ে উঠি আমরা এবং বড় হয়ে ওঠার সাথে সাথে আমাদের স্বপ্নগুলোও বদলে যায়।

আমরা বুঝতে শিখি আসলেই আমরা কি চাই। জীবনের চাহিদার আর প্রাপ্তি সাথে সাথে বদলে যায় আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি।

যেমন বাংলাদেশের যতগুলো মেডিকেল কিংবা ইঞ্জিনিয়ার কলেজ আছে সেগুলোতে সকল ছাত্রদের পড়ার জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ নেই। আবার একটি দেশের সকলেই একই পেশার কাজ জানলে দেশটি কিভাবে সমৃদ্ধ হবে?

দেশকে এগিয়ে দিয়ে যাওয়ার জন্য সকল পেশাজীবীরই অবদান আছে। বর্তমান সময়ে খুবই প্রচলিত একটি শব্দ উদ্যোক্তা। শিশুরাও এখন উদ্যোক্তা হওয়াকে জীবনের লক্ষ্য হিসাবে গ্রহন করছে।

উদ্যোক্তা হতে চাই বিষয়টি এখন এতটাই জনপ্রিয় যে, ও.এস.ডি ২০১৯ সালের এক গবেষনায় দেখা গেছে যুক্তরাষ্টের ৯০ শতাংশ পুরুষ এবং ৫৮ শতাংশ নারী নিজেদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ব্যপারে আগ্রহী। তাহলে কি এই উদ্যোক্তা? উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য কি কি ডিগ্রি প্রয়োজন? চলুন আজ এ নিয়ে আরোচনা করি।

উদ্যোক্তা কি

সহজ কথায় উদ্যোগ যিনি নেন, তিনিই উদ্যোক্তা। নিজে থেকেই যখন কেউ কোন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন তাকেই উদ্যোক্তা বলা হয়। এই উদ্যোক্তা যখন সফল হয়ে উঠেন তখন তিনি ব্যবসায়ী। পড়ুন – ব্যবসায়ী এবং উদ্যোক্তাদের মধ্যে পার্থক্য

মূলত একজন উদ্যোক্তা তখনই উদ্যোক্তা হয়ে ওঠেন যখন তিনি নিজের সাথে সাথে আরো কিছু মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেন। উদ্যোক্তাদের এক কথায় বলা যায় স্বপ্নবাজ মানুষ।

চাকুরি কিংবা পৈত্রিক প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির দায়িত্ব নেওয়ার বদলে এদের মনে থাকে নিজে কিছু গড়ে তোলার অদম্য ইচ্ছা। এই ইচ্ছাই তাদের মূল চালিকা শক্তি। বাংলাদেশের মানুষের এক সময় উদ্যোক্তার হওয়ার প্রতি তেমন কোন আকর্ষন ছিল না। খুব কম মানুষই উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন লালন করতেন।

তবে এই পরিস্থিতি এখন অনেকটাই পরিবর্তিত। দিন দিন মানুষ উদ্যোক্তা হওয়ার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছে, বিশেষ করে আমরা তরুন প্রজন্ম। এর ফলে আমাদের অর্থনীতিতেও আসছে ইতিবাচক পরিবর্তন।

উদ্যোক্তা হতে চাইলে কি ডিগ্রি প্রয়োজন?

সন্তান যখন উদ্যোক্তা হতে চাইছে, তখন বাবা মার মনে প্রশ্ন আসতেই পারে তাহলে আমার ছেলে বা মেয়ে কোন বিষয়ে পড়াশোনা করা উচিত। আগেই বলেছি আমাদের দেশে এখনো এই বিষয়টি অনেকটাই নতুন এবং সকলে এই বিষয়ে বিস্তারিত জানে না।

তাই বাবা-মার মনে প্রশ্ন আসতেই পারে কি পড়বে আমার সন্তান? যেমন ডাক্তার হতে চাইলে আছে মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ার হতে চাইলে আছে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, শিক্ষক হতে চাইলে আছে বিষয় ভিত্তিক পড়াশোনা।

উদ্যোক্তা হতে চাইলে তাহলে কি পড়াশোনা করা উচিত? একজন সফল উদ্যোক্তা হয়ে উঠতে চাইলে আপনার সমন্বিত জ্ঞান প্রয়োজন।

একটু কঠিন লাগছে? কঠিন কিছু নয়।

উদ্যোক্তা হতে চাইলে নির্দিষ্ট কোন ডিগ্রির প্রয়োজন নেই। আপনি বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষ্যা, কিংবা মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থী হয়েও সফল উদ্যোক্তা হতে পারবেন।

একজন উদ্যোক্তা হতে চাইলে আপনাকে জানতে হবে যেমন আপনার পন্য সম্পর্কে, ঠিক তেমনি বাজার, মার্কেটিং, অর্থনীতি সম্পর্কেও জানতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে পণ্যেও চাহিদা, ক্রেতার সন্তুষ্টি এবং বিশ্বাস অর্জনের।

আপনাকে আসলে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান রাখতে হবে। জানার সীমা পরিসীমাকে বাড়িয়ে তুলতে হবে। সরাসরি উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য তেমন কোন ডিগ্রি আমাদের দেশ নেই।

তবে বর্তমানে প্রায় সব সরকারি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবসায়ী শাখার শিক্ষার্থীদের ‘অন্ট্রোপ্রেনারশিপ’ কোর্স করানো হয়। এই কোর্স না করলে আপনি উদ্যোক্তা হতে পারবেন না, বিষয়টা মোটেই এই রকম না।

একজন সফল উদ্যোক্তা হয়ে উঠার জন্য আপনার তেমন কোন সার্টিফিকেট দরকার নেই, নেই কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। তবে আপনাকে জানতে হবে প্রচুর। শেখার জন্য এখন আমাদের হাতে রয়েছে ইন্টারনেট।

সুতরাং আপনি যা শিখতে চান, আপনি সহজে ঘরে বসেই সেটি শিখতে পারেন। আমরা অনেকই মনে করি, একজন সফল উদ্যোক্তা হতে চাইলে যুগান্তকারী কোন আইডিয়া লাগে, আসলে বিষয়টি এমন নয়। সাধারন কোন আইডিয়া দিয়েও আপনিন সফল উদ্যোক্তা হয়ে উঠতে পারেন।

অনেকের মাথায় অনেক আইডিয়া থাকে। কেউ কেউ কোন একদিন করবে ভেবে বসে থাকে, কেউ কেউ টাকার অভাবকে দায়ী করে। আসলে এদের সফলতার পিছনে একমাত্র বাঁধা হল উদ্যোগ না নেওয়া, প্রচেষ্টা না করা।

আপনি নিজে ২ পা না আগালে আপনাকে সাহায্য করার জন্য কেউ হাত বাড়িয়ে দিবে না। প্রথম পদক্ষেপটি আপনাকেই নিতে হবে। এটাই নিয়ম।

উদ্যোক্তা হতে চাইলে কি কি প্রয়োজন?

১। সাহস

একজন সফল উদ্যোক্তা হয়ে উঠতে চাইলে আপনাকে অবশ্যই সাহসী হতে হবে। সাহস ছাড়া উদ্যোক্তা হওয়া সম্ভব নয়। উদ্যোক্তা হয়ে ওঠা মোটেই সহজ কিছু নয়। আপনাকে লড়াই ক্রমাগত চালিয়ে যেতে হবে।

ধনী পরিবারের সন্তানদের ক্ষেত্রে এই লড়াই কিছুটা সহজ হলেও, মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য এটি বেশ কঠিন একটি বিষয়। এক্ষেত্রে আপনার সাহসই সবচেয়ে বড় শক্তি।

মনে রাখবেন আপনার সফলতার ভাগ সবাই নিতে চাইবে, কিন্তু ব্যার্থতার ভার শুধুই আপনার। একা চলার সাহস এক্ষেত্রে বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

কারন ইতিহাস এবং বর্তমান পরিস্থিতি বলে, উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার এই যাত্রায় আপনি প্রায় কাউকেই পাশে পাবেন না। আপনাকে লড়তে হবে একা।

একা পথচলার জন্য একজন মানুষকে যথেষ্ট সাহসী হতে হয়। সুতরাং সফল উদ্যোক্তা হয়ে উঠতে চাইলে আপনাকে সাহসী হতে হবে সবার আগে।

২। লক্ষ্য স্থির থাকতে হবে

পরিকল্পনা কম বেশি সবাই করি। কিন্তু সব সময়ই পরিকল্পনা মোতাবেক কাজ হয় না। আর তাই পথ পরিবর্তন করতে হতে পারে, সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের প্রয়োজন পড়তে পারে। কিন্তু লক্ষ্যে স্থির থাকতে হবে।

আপনার পথ বদলে যেতে পারে কিন্তু কোন ভাবেই আপনার লক্ষ্য থেকে সরে আসা যাবে না। যতবার আপনি পড়ে যাবেন, ততবার উঠে দাঁড়ানোর মত মনের শক্তি থাকা প্রয়োজন। আপনি যখন লাগামহীন ভাবে চেষ্টা করবেন, সফলতা ধরা দিতে বাধ্য।

৩। ধৈর্য্য

ধৈর্য্য এমন একশক্তি যা সবার থাকে না। মনে করুন একই শিক্ষকের কাছে ২ জন ছাত্র পড়াশোনা করে। একজন মেধাবী ছাত্র এবং একজন অপেক্ষাকৃত কম মেধাবী।

মেধাবী ছাত্রের লেখাপড়ার প্রতি কম আগ্রহ, সে পরীক্ষার আগে পড়তে ভালবাসে। আর অপেক্ষাকৃত কম মেধাবী ছাত্রটি সারা বছরই লাগামহীন ভাবে চেষ্টা করেই যায়। বলতে পারেন বছর শেষে কে বেশি ভাল ফলাফল অর্জন করবে?

নিঃসন্দেহে সেই ছাত্রটিই ভাল ফলাফল অর্জন করবে যে, প্রতিনিয়ত পরিশ্রম করে গেছে। এই পরিশ্রম এবং ধৈর্য্যর ফল সে নিশ্চয়ই পাবে।

উদ্যোক্তা হওয়ার প্রথম দিকের সময়টাই সবচেয়ে কঠিন। কারন আপনাকে কেউ চিনে না, ফলে আস্থা অর্জন করা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। এমন অবস্থায় আপনি যদি ধৈর্য্য সহকারে চেষ্টা করতে পারেন, সফলতা আসবেই।

৩। ঝুঁকি গ্রহনের মানসিকতা

বিনিয়োগ মানেই ঝুঁকি। সবকিছু পরিকল্পনা অনুসারে চলবে এমন না ভাবাই ভাল। বিরূপ পরিস্থিতি যেকোন সময় আসতে পারে। আর তার জন্য আপনাকে প্রস্তুত থাকতে হবে। বড় বড় ঝুঁকি নিতে হতে পারে।

তবে বিষয় হল ঝুঁকি গ্রহনের ক্ষেত্রে আপনাকে সচেতন থাকতে হবে। ঝুঁকি গ্রহনের ক্ষেত্রে আপনাকে বিচার বুদ্ধিও যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। নদীতে নামার আগে এর  গভীরতা মেপে নেওয়া উত্তম।

৪। পরিশ্রম

একজন মানুষ সফল হতে চাইলে তাকে পরিশ্রম করতেই হবে। পরিশ্রমের কোন বিকল্প নেই। বিল গেটস, জ্যাকমা কিংবা ওয়ারেন বাফেট কিংবা এলন মাস্ক সহ পৃথিবীর র্শীষ ধনীব্যক্তিরা দিনে ১২/১৩ ঘন্টার বেশি কাজ করেন।

এত সফল এবং এত ধনী হওয়ার পরও তারা প্রতিদিন এত পরিশ্রম করেন। তবে একজন উদ্যোক্তা হিসাবে আপনি যখন কাজ শুরু করতে চাইছেন তখন আপনাকে কত বেশি পরিশ্রম করতে হবে সেটি ভেবে দেখুন। প

রিশ্রমের বিকল্প কিছুই হতে পারে না। যেকোন বিষয়ে আপনি সফল হতে চাইলে আপনাকে পরিশ্রম করতেই হবে।

৫। সিদ্ধান্ত গ্রহনের ক্ষমতা

সিদ্ধান্ত গ্রহন একটি বড় গুন। আপনি উদ্যোক্তা হিসাবে সফল হতে চাইলে আপানকে সিদ্ধান্ত গ্রহনের ক্ষমতা থাকতে হবে। বিশ্লেষনী ক্ষমতা এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়াটা ভীষন জরুরি। উদ্যোক্তার কাজে আপনাকে যেকোন পরিস্থিতিতে তাৎক্ষনিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। জেনে নিন – সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া উন্নত করতে ৫ পদক্ষেপ নিতে হবে 

আপনি সব সময়ে অন্যের পরামর্শ নেওয়ার সুযোগ নাও পেতে পারেন। তাই এজন্য সফল উদ্যোক্তা হওয়ার যোগ্যতার মধ্যে অন্যতম হল, সিদ্ধান্ত গ্রহনের ক্ষমতা। পড়ুন – যে ৯টি গুনাবলী উদ্দ্যোক্তার সাফল্য বয়ে আনে

৬। জ্ঞানের সীমা বাড়াতে হবে এবং প্রতিনিয়ত আপডেট থাকতে হবে

যেকোন বিষয়ে কাজ করার জন্য আপনাকে সেই বিষয় সম্পর্কে ভালভাবে জানতে হবে, বুঝতে হবে। তাই একজন উদ্যোক্তাকে অবশ্যই তার কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল কিছু জানতে হবে।

প্রতিনিয়ত বিশ্ববাজারে যে পরিবর্তনগুলো হচ্ছে, সেগুলো সম্পর্কে তাকে অবশ্যই জ্ঞান রাখতে হবে। সময়ের সাথে পরিবর্তন হওয়ার ক্ষমতা তার সফলতার পথকে প্রশস্ত করবে।

৭। সুদূরপ্রসারী চিন্তা ভাবনা

একজন উদ্যোক্তার দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হওয়া প্রয়োজন। বর্তমান চাহিদার পাশাপাশি অদূর ভবিষ্যৎতে কি কি চাহিদা তৈরী হতে পারে, কি কি সমস্যার সম্মূখীন হতে পারে, সে বিষয়ে চিন্তা ভাবনার প্রয়োজন। এই সুদূরপ্রসারী চিন্তা ভাবনা অন্যদের থেকে তাকে এগিয়ে রাখবে অনেকটা।

আমাদের দেশে স্বপ্ন লালিত হয় পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির ওপর। সমাজ কি চায়, আত্মীয়-স্বজনের চোখে কি ভাল সেটাই হয়ে ওঠে আমাদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। এই ধরাবাঁধা নিয়ম থেকে যারা বেরিয়ে আসে তারাই মূলত সফল হয়ে উঠে।

উদ্যেক্তা হলো অনেকগুলি গুনাবলির সমষ্টিগত রূপ।

আপনাকে বিজ্ঞান বিভাগের থেকে যেমন নতুন নতুন টেকনোলজি জানতে হবে, গবেষনার ফলাফল জানতে হবে, ব্যবসায়িক শাখা থেকে পরিসংখ্যান, ফাইন্যান্স, মার্কেটিং সহ আরো অনেক কিছু শিখতে হবে। অর্থনীতি, মনোবিজ্ঞান ছাড়া আপনি সফল উদ্যোক্তা হয়ে উঠতে পারবেন না।

যে যত বেশি জানে, সে তত বেশি সফল। একজন উদ্যোক্তা নিঃসন্দেহে সৃজনশীল মানুষ। তিনি চায় কিছু সৃষ্টি করতে। এই সৃজনশীলতাই তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে। ভিজিট করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল – Bangla Preneur YouTube Channel